দেশজুড়ে
বাঘায় ঈদের আনন্দ স্পর্শ করবে কল্যাণী শিশু সদনের অসহায় শিশুদের?
আর মাত্র কয়েক দিন পরেই আসছে মহা আনন্দের ঈদ। এই ঈদ উৎসবকে কেন্দ্র করে সাধ্যমতো কেনাকাটায় ব্যস্ত সবাই। শিশু কিশোররা নতুন জামা-কাপড় পরে মাতবে ঈদের আনন্দে, এটাই স্বাভাবিক। ব্যতিক্রম কেবল রাজশাহীর বাঘা উপজেলার কল্যাণী শিশু সদনের অসহায় শিশুরা। অন্য সবার মতো তাদের কোমলমতি মনেও ঈদ উঁকি দেয়। তবে ঈদের আনন্দ কি তাদের স্পর্শ করবে? ঘুরে বেড়াতে পারবে নতুন পোশাক পরে?
ইটের দেয়ালে টিনশেড ঘর। বাইরের সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে সরেরহাট কল্যাণী শিশু সদন। ভেতরে-বাইরে শিশুদের কোলাহল। এরই মধ্যে লুকিয়ে আছে এক মানুষের অক্লান্ত শ্রম আর অসাধারণ কীর্তিগাঁথা। এটি রাজশাহী জেলার একেবারে শেষ সীমানায় পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত। কল্যাণী শিশু সদন এর অবস্থান রাজশাহী শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার পূর্বে বাঘা উপজেলার সরেরহাট গ্রামে।
এর পরিচালক সাদা মনের মানুষ পল্লী চিকিৎসক শামসুদ্দিন ওরফে সমেশ ডাক্তার জানান, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে ফিরে যুদ্ধে নিহত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন একটি ছোট্ট এতিমখানা। যার নাম দেওয়া হয় ‘সরেরহাট কল্যাণী শিশু সদন’। শুরুতে এখানে এতিমের সংখ্যা ছিল ৫৬ জন। বর্তমানে তা বেড়ে দাড়িয়েছে ১৬৯ জনে। এতিমদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের দুঃখ দুর্দশার নানা কথা। এ সময় উপস্থিত সমেশ ডাক্তার জানান, এতিমদের বেদনা তাকে কাতর করে। তাই স্ত্রী মেহেরুন্নেসাকে মোহরানা বাবদ দেওয়া অর্থে ১২ শতাংশ জমি কিনে সেখানে একটি ঘর তুলে তিনি চালু করেন এতিমখানাটি। ১৯৮৪ সাল থেকে টানা ১০ বছর তার নিজের ১৭ বিঘা জমি বিক্রি করে এই এতিমখানাটি পরিচালনা করেছেন। আশ্রয়হীনদের ব্যবস্থা করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত একমাত্র বসতভিটা বিক্রি করে নিজেই পরিবার নিয়ে হয়ে পড়েন গৃহহীন।
উপায় না দেখে শেষ পর্যন্ত স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে নিজের গড়া এতিমখানাতেই আশ্রয় নিতে হয় তাকে। স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে এখন ১৬৯ জন এতিম শিশুর মাঝে থাকেন সমেশ ডাক্তার। তারা একসঙ্গে ঘুমান এবং একই খাবার খান। তিনি এসব অবহেলিত শিশুদের জন্য অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার ব্যবস্থা রেখেছেন। এখানে পাঠ দান করান তার নিজের ছেলে-মেয়েরা। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় বর্তমানে অনেকেই বাইরে পড়া-লেখা করছে। মহানুভবতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৬ সালে তিনি “সাদা মনের মানুষ’’ খেতাব পেয়েছেন। ক্ষোভের সঙ্গে সমেশ ডাক্তার বলেন, এসব খেতাব দিয়ে পেট ভরে না। তাকে কারিতাসের দেওয়া একটি ট্রাক্টর দিয়ে মানুষের জমি চাষ করে টাকা রোজগার করতে হয়েছে এতিম সন্তানদের জন্য। বর্তমানে সেটিও নষ্ট অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এরপরও অনেক এতিমকে খেতে হয় এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে।
সমেশ ডাক্তার আরো জানান, এই এতিমখানাটি ১৯৯৪ সালে সরকারিভাবে রেজিস্ট্রেশন পায়। সে সময় কারিতাস নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অর্থে আরও কিছু ঘরবাড়ি তৈরি হয় এবং তারা ১০ জন এতিমকে ৩ বছর মাথা পিছু ৪শ’ টাকা করে উপবৃত্তি দিত প্রতিমাসে। ৫ বছর পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় সরকার ১৯ জনকে উপবৃত্তি দিতে শুরু করে। পরে এতিমদের সংখ্যা ১১৫ জনে দাঁড়ালে সরকারিভাবে বৃত্তি পেত ৩৫ জনের নামে। যা এখন আর পান না।
চলতি অর্থ বছরে এ সকল এতিমদের জন্য সরকারিভাবে অনুদান পেয়েছেন মাত্র ৫ লক্ষ ৪ হাজার টাকা এবং বেসরকারিভাবে ৭ লক্ষ টাকা অনুদান পেয়েছেন। মোট অনুদান পেয়েছেন ১২ লক্ষ ৪ হাজার টাকা। এদের জন্য প্রতি মাসে ব্যয় হয় ২ লক্ষ টাকা। এতে এক বছরে ব্যয় হয়েছে ২৪ লক্ষ টাকা। বর্তমানে বিভিন্ন দোকান পাটে ঋণ রয়েছে ১২ লক্ষ টাকা। আগামীতে যদি সরকারি-বেসরকারি অনুদান বৃদ্ধি না পায় তবে বর্তমানে এতিমরা ২/১ বেলা খেতে পেলেও আগামী দিনগুলো অনাহারে কাটাতে হবে।
বর্তমানে দেশের রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ১৬৯ সন্তানের অভিভাবক হিসেবে দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে তিনি এগিয়ে চলেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ১১৮ জন ছেলে এবং ৫১ জন মেয়ে। তিনি এতিমদের মুখের দিকে চেয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, এসব বাচ্চারা সারাবছর ৩ বেলা ভালোভাবে খেতেও পায় নি। আবার চলতি রমজান মাসে কত মানুষই তো কত ভালো ভালো খাবার ও জামা-কাপড় কিনছেন; কিন্তু তার সন্তানদের জন্য তিনি এখন পর্যন্ত কিছুই করতে পারেন নি। তবে কোন এক প্রতিষ্ঠান এতিম বাচ্চাদের জন্য রমজান উপলক্ষে কিছু পোশাক পাঠিয়েছেন। তিনি এতিমদের জন্য সরকারিভাবে অনুদান বৃদ্ধি ও সমাজের বিত্তবানদের কাছে সাহায্য কামনা করেছেন।